ইদ্রিসুর রহমানঃ
সমতল জেলা গুলোর ন্যায় পার্বত্য অঞ্চলেও রয়েছে বাঙালী ঐতিহ্যের মাটির ঘর। পাহাড়েও রয়েছে এ ঘরের প্রচলন। এরই ধারাবাহিকতায় রাংগামাটি জেলার বিভিন্ন উপজেলা গুলোতেও রয়েছে অনেক পুরোনো গ্রাম বাংলার বেশকিছু ইতিহাস ও ঐতিহ্য। তার মধ্যে মাটির ঘর অন্যতম। শীত ও গরমে বেশ আরামদায়ক বলে ধনী-গরিব সবাই এ ঘর তৈরি করতো। হরেক রকম ঘর তৈরি হতো সাধ্যানুযায়ী। কেউ কেউ দুই তলা মাটির ঘরও তৈরি করতেন।
আধুনিক মনোরম কারুকার্য খচিত ইট ও টিনের তৈরি পাকা-আধাপাকা ঘরবাড়ির ব্যাপক বিস্তারে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার সেই ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ অতীত সুখ দুঃখের নিরাপদ আশ্রয় প্রাকৃতিক রেফ্রিজারেটর খ্যাত মাটির ঘর।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অতীতে মাটি দিয়ে বিশেষ উপায়ে ঘর নির্মাণ করা হতো। চালা হিসেবে এসব ঘরে মানুষ খড়, ছন, ইকর, টিন এসব ব্যবহার করতেন। আবার চালা তৈরিতে বাঁশ অথবা ইট ব্যবহার করতেন। বাড়ির মালিক স্বহস্তে অথবা কারিগর দিয়ে সুন্দর সুন্দর মাটির ঘর তৈরি করতেন। মাটির ঘর বাড়ির সঙ্গে মিশে আছে গ্রামবাংলার মানুষের নিবিড় সম্পর্ক, রয়েছে হারানো স্মৃতি, প্রিয় মানুষদের সুখ দুঃখের স্মৃতি, আবেগ আর অনুভূতি।
নানিয়ারচর উপজেলার ইসলামপুর, ডাক বাংলা, বুড়িঘাট ও বগাছড়িতে রয়েছে প্রায় এক শতাধিক মাটির তৈরী ঘর।
ইসলামপুর এলাকায় বসবাসকারী মাটির তৈরী ঘরের বাসিন্দা মোঃ মিন্টু আকন এর নিকট মাটির ঘরের সুবিধা সম্পর্কে যানতে চাইলে তিনি বলেন, এই ঘরগুলো ইট, টিন ও কাঠের তৈরী ঘরের থেকেও বেশ আরামদায়ক।
সাধারণত ইট দিয়ে একটি গৃহ নির্মাণের ব্যায় প্রায় অনেক টাকা যা সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে। আর টিন এবং কাঠ দ্ধারা নির্মাণ করলে কয়েক বছর অন্তর অন্তর পরিবর্তন করতে হয়। কিন্তু মাটির ঘরে খরচও যেমন কম। এই ঘরে বাস করতেও শান্তির।
স্থানীয় বাঙালী পরিবারের পাশাপাশি পাহাড়ের আনাচে-কানাচেও রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধিকারক মাটির তৈরী এমন ঘর। পাহাড়ি জনপদের লোক গুলোও বেশ আনন্দের সাথে উপভোগ করে মাটির তৈরী এসব ঘর।
তবে নানিয়ারচরে বিলুপ্তি হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী মাটির তৈরি আধুনিক ঘরগুলোও। গ্রামের মানুষের কাছে মাটির ঘর এখন ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে।
বর্তমানে টিনের চালা দিয়ে কিছু মাটির ঘর দেখা গেলেও বাঁশ, খড়ের ও শনের চালার সেই মাটির ঘরগুলো আজ আর নেই বললেই চলে। বিলুপ্তি হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী মাটির তৈরি আধুনিক ঘরগুলোও।
নানিয়ারচর উপজেলায় বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিনিয়ত মাটির ঘর বাড়ির বদলে জায়গা করে নিচ্ছে ইট পাথরে নির্মিত আধুনিক বিলাসবহুল পাকাবাড়ি। আধুনিক যুগের আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের মানসিকতা ও ভাবধারার পরিবর্তন ঘটছে। ধনীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে এ অঞ্চলের খেটে-খাওয়া মানুষরাও। এখন মাটির ঘর ভেঙে তৈরি করছেন দালান ঘর। প্রাকৃতিক রেফ্রিজারেটর খ্যাত মাটির ঘর ভেঙে পাকা ঘর নির্মাণের এক কৃত্রিম প্রতিযোগিতা চলছে সর্বত্র।
মাটির ঘর তৈরী কারক এক কারীগর এর সাথে আলোচনায় জানা যায়, একটা সময় এই ঘর তৈরীর জন্য সময় বের করা খুব কষ্ট সাধ্য হতো কিন্তু বর্তমানে বেশ কিছু দিন যাবৎ একাজে সাড়া না পাওয়ায় আমারাও সামিল হয়েছি অন্যান্য কাজের সাথে।
যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এ অঞ্চলে মাটির ঘরের অস্তিত্ব সংকট দেখা দিয়েছে। এসব মাটির ঘর তৈরির কাজে গ্রামাঞ্চলে অনেক কারিগর ছিলো। ঘরগুলো বিলুপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কারিগরদের পেশাও পাল্টে গেছে। অনেকের জীবনধারাও পাল্টে গেছে। অনেক কারিগর এখন আর বেঁচে নেই। অনেকে বেঁচে থাকলেও বহু কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। ভিন্ন পেশায় কাজ করলেও কারিগররা মনে এখনো সেই স্মৃতি নিয়ে ঘুরে বেডান। বাঁশ, খড় ও শনের চালার সেই মাটির ঘরগুলো আজ বিলুপ্তপ্রায়।