মেহেদী ইমামঃ
সাম্প্রতিক পার্বত্য চট্টগ্রামে ঘটে যাওয়া সহিংসতা ও সংঘর্ষের ঘটনায় আতঙ্কিত এই জনপদে কতটুকু ফিরেছে স্বস্তি এই নিয়ে মিলছে প্রশ্ন। পাহাড়ে বসবাসরত পাহাড়ি বাঙালি সহ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির কেইবা কতটুকু স্বস্তিতে ফিরতে পেরেছে সেটাই জানতে চেষ্টা করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
রোববার (২৯ সেপ্টেম্বর) সরেজমিনে রাঙামাটি শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পার্বত্য এই এলাকায় শান্তি ফিরেছে কিছুটা। তবে পুরোপুরিভাবে আজও কাটেনি সংশয়। অর্জিত হয়নি কাঙ্খিত স্থিতিশীলতা। স্থানীয়দের মাঝে সম্প্রীতি ফেরাতে কাজ করে যাচ্ছে প্রশাসন।
১৯৯৭সালের ২রা ডিসেম্বর তৎকালিন সরকার ও পার্বত্য ”ট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে করা শান্তিচুক্তির পরে পাহাড়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সড়ক যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থার ফলে এই জনপদে স্বস্তি ফিরেছে। তবে অবৈধ অস্ত্র, চাঁদাবাজি ও আঞ্চলিক সশস্ত্র দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলে মেলেনি কাঙ্খিত ফলাফল।
অবৈধ অস্ত্র ও চাদাঁবাজির ফলে পাহাড়ে বিরাজমান সমস্যা সূদৃঢ় হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তারা। পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরী হয়ে পড়েছে বলেও জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
বিশেষ একটি সূত্রে জানা যায়, খাগড়াছড়ি-রাঙামাটির সাম্প্রতিক সহিংসতা ভয়াবহ সংঘর্ষে রুপ নিলেও তা নিয়ন্ত্রণে আনতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চলছে। পাহাড়ে টহল বাড়িয়েছে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরি সদস্যরা।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, উস্কানি, গুজব ও আতঙ্কে পরিস্থিতি গড়িয়েছে ভিন্ন মাত্রায়। সরকারের উন্নত পরিকল্পনা ও আঞ্চলিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দল থামানো গেলে দৃঢ় হবে সম্প্রীতির বন্ধন।
এদিকে খাগড়াছড়ি জেলায় অপ্রীতিকর ঘটনার জেরে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলায় উদ্ভূত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সরেজমিনে পরিদর্শন ও তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য গত বৃহস্পতিবার ৭সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি ঘোষণা করেছে সরকার।
এতে চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) কে আহ্বায়ক, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এবং সংশ্লিষ্ট তিন জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপারদের সদস্য করে অফিস আাদেশে এই কমিটি ঘোষণা করা হয়। আদেশে উল্লেখ করা হয়, সংঘটিত সহিংস ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান, জড়িতদের চিহ্নিতকরণ ও ভবিষ্যতে এ জাতীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে যথাযথ সুপারিশ প্রণয়ন করতে বলা হয়।
এর আগে সহিংসতার এই ঘটনায় পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও সমাধানের জন্য উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করেছে। যার মধ্যে ছিলেন, অন্তবর্তিকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোঃ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, স্থানীয় সরকার পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় উপদেষ্টা এএফ হাসান আরিফ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক উপদেষ্টা সাবেক রাষ্ট্রদূত (অব.) সুপ্রদীপ চাকমাসহ ডিজিএফআই, এনএসআই প্রধান, আইজিপি, সেনাবাহিনীর চট্টগ্রামের জিওসি, বিভাগীয় কমিশনার, রাঙামাটি রিজিয়ন ও জোন কমান্ডার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগের কর্মকর্তারা।
উচ্চ পর্যায়ের এই প্রতিনিধি দলটি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে সহিংসতা থামানোর বিভিন্ন উপায় নিয়ে আলোচনা করেন। এদিন রাঙামাটি রিজিয়নের প্রান্তিক মাল্টিপারপাস হল রুমের সামনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নেরও জবাব দেন সরকারের এই প্রতিনিধি দল।
এসময় সরকারের প্রতিনিধি দলের সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ পাহাড়ে শান্তি ও সম্প্রীতি নিয়ে কথা বলেন। উপদেষ্টারা এসময় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের ও প্রতিশ্রুতি দেন। ঐদিন রাঙামাটি সম্প্রীতি সমাবেশ শেষ করে খাগড়াছড়ি পরিদর্শন করেন উপদেষ্টা মন্ডলির এই দলটি।
অপরদিকে সম্প্রতি পার্বত্যাঞ্চলের দুর্গম এলাকা ও সেনা জোন পরিদর্শন করেন সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। রাঙামাটির নানিয়ারচর জোন (১০ বীর) পরিদর্শন করেন তিনি।
বিশেষ সূত্রে জানা যায়, এই পরিদর্শনের মূল উদ্দেশ্য ছিল স্থিতিশীলতা রক্ষা, সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সহযোগিতা বাড়ানো।
বিশেষ করে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির দুর্গম অঞ্চলে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর মনোবল বৃদ্ধিও ছিল অন্যতম লক্ষ্য।
এসময় তিনি সেনাবাহিনীর সদস্যদের সতর্ক অবস্থায় থাকার নির্দেশনা দেন এবং স্থানীয় প্রশাসন এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করে সমন্বিত প্রচেষ্টা চালানোরও নির্দেশ দেন।
পাহাড়ের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় মৃণাল কান্তি চাকমা বলেন, মনে হচ্ছে আতঙ্ক কেটেছে। কিন্তু আগামীতে কি হয় সেটা নিয়ে সন্দিহান। আজ দিন ভালো যাচ্ছে বলে কাজে বের হয়েছি। আগামীকাল আবারো কাজে আসতে পারবো কিনা সেটা কালই বলতে পারবো। আমরা শান্তি চাই তবে সবাই তো আর শান্তি চাইনা। কেউ কেউ পাহাড়ে অশান্তি সৃষ্টি করে।
সিএনজি চালক বাপ্পি জানান, শহরের মধ্যে আতঙ্ক কেটেছে। তবে আসামবস্তি-কাপ্তাই এবং রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কের কিছু জায়গায় এখনও আতঙ্ক বিরাজ করছে। তরপরও পাহাড়িদের কে চাঁদা দিচ্ছি বলে গাড়ি চালাতে পারি। ঐসব এলাকায় চাঁদা ছাড়া গাড়ি চালানো সম্ভব না।
শহরের বনরুপা-সমতাঘাট সড়কের পান ব্যবসায়ী হেলাল জানান, আতঙ্ক কিছুটা কেটেছে। তবে হাটে আসা পাহাড়ি ক্রেতা-বিক্রেতাদের উপস্থিতি স্বাভাবিকের তুলনায় কিছুটা কম। সংঘর্ষের ঘটনায় আজও তার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেননি বলেও দাবি করেন তিনি।
জানতে চাইলে একই এলাকার ব্যবসায়ী বিশ্বজিৎ জানান, পাহাড়িদের উপস্থিতি এখনও কম। এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে কিছুটা সময় লাগবে বলেও মনে করেন তিনি।
তবে পাহাড়িদের মধ্যে আতঙ্ক কেটে স্বস্তি ফিরেছে বলেও দাবি করেন একই এলাকার এক মোবাইল রিচার্জ ব্যবসায়ী। তিনি জানান, পাহাড়িদের মাঝেও ফিরেছে স্বস্তি। আতঙ্ক না কাটলে তো আর কেউ হাটে আসতো না বলেও দাবি করেন তিনি। তিনি আরো জানান, সবকিছু ঠিক হতে কিছুটা সময় লাগবে। তবে এঘটনার পুনরাবৃত্তি ও চাননা তিনি।
এবিষয়ে জানতে চাইলে মুঠোফোনে রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান বলেন, পাহাড়ের আতঙ্ক কাটিয়ে সব কিছু স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে। ইতোমধ্যে আমরা দেখতে পেয়েছি হাট-বাজার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ খুলেছে। পাহাড়ে বসবাসরত পাহাড়ি বাঙালিসহ সকল সম্প্রদায়ের মাঝে আমরা সেবা প্রদান করে যাচ্ছি। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আমরা সম্প্রীতি সমাবেশ করেছি। এছাড়াও ১০টি পাড়া-মহল্লায় আমরা শান্তি কমিটি করে দিয়েছি। এলাকাবাসীর মধ্যে সম্প্রীতি ফেরাতে জেলা প্রশাসন নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য খাগড়াছড়ির পাহাড়ি-বাঙালির সংঘর্ষের রেশ পার্বত্য জেলা রাঙামাটি শহরে ছড়ানো, সাম্প্রদায়িক হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে উত্তেজনা বিরাজ করেছে সারাদেশে। এঘটনায় বিরুপ প্রতিক্রীয়া দেখা যায় এলাকার অর্থনৈতিক খাতসহ পর্যটন শিল্পে। বেশকিছু দিন থমথমে অবস্থা বিরাজ করলেও এরই মধ্যে ফিরে দাড়াতে শুরু করেছে এই জনপদ। শান্তি ও সম্প্রীতির অটুট বন্ধনে আবদ্ধ হতে চান এই এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা।